বর্ষা এলে খুলনা যেন ডুবে যায়। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা, অলিগলি, স্কুল, হাসপাতাল এমনকি প্রধান সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যায়। ঘন্টার পর ঘণ্টা, কোথাও কোথাও দিনে দিনে পানি নেমে না যাওয়ায় নগরজীবন কার্যত থমকে দাঁড়ায়। এ যেন একটি নগরীর ‘নিয়মিত দুর্যোগ’।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এত বছর ধরে সমস্যা চিহ্নিত থাকার পরও খুলনার জলাবদ্ধতা কমছে না-বরং বাড়ছে? এটা কি শুধুই প্রকৃতি বা অতিবৃষ্টির দোষ, নাকি আমাদের উন্নয়নের নামে নেওয়া পরিকল্পনাহীন সিদ্ধান্ত, অব্যবস্থাপনা ও দখলবাজির নির্মম প্রতিফলন?
খুলনা শহরের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই এখন বর্ষাকালে পানি জমে থাকে। ড্রেন উপচে পড়ে রাস্তায়। নর্দমার পানি ঢুকে পড়ে ঘরে। গৃহবন্দি হয়ে যায় মানুষ, বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট, স্কুল, অফিস। রূপসা নদীর তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা এই শহর প্রকৃতিগতভাবে একটু নিচু হলেও, ইতিহাস বলছে-একসময় এই শহরে বৃষ্টি হলেই এমন জলাবদ্ধতা হতো না।
আজ খুলনায় পানি নামতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগে। কারণ খুলনার নর্দমা ও খালগুলো প্রায় মৃত। শহরের অন্তত ৬০ শতাংশ খাল ও জলাধার দখল হয়ে গেছে। বেশ কিছু খাল মানচিত্রে থাকলেও বাস্তবে সেগুলো এখন আবর্জনার স্তূপ বা বাণিজ্যিক স্থাপনায় রূপান্তরিত।
বুয়েটের একটি গবেষণা বলছে, খুলনার অধিকাংশ ড্রেনের নকশা তৈরি হয়েছিল ১৯৮০’র দশকে, যখন শহরের আয়তন ও জনসংখ্যা ছিল অর্ধেকেরও কম। অথচ এখনকার কয়েকগুণ বৃষ্টিপাত সামাল দেওয়ার মতো কোনো নতুন ড্রেনেজ অবকাঠামো তৈরি হয়নি। খুলনা সিটি কর্পোরেশন কাগজে-কলমে অনেক প্রকল্পের কথা বললেও, বাস্তবায়নে তা প্রায় নিস্তেজ।
খুলনায় উন্নয়ন ও পরিকল্পনার দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছে তিনটি প্রধান সংস্থা-খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেইউডিএ) এবং ওয়াসা। দুঃখজনকভাবে, এই তিন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় প্রায় নেই বললেই চলে।
একটি সংস্থা রাস্তা কাটে ড্রেন বসাতে, আরেকটি পরে সেটি ভরাট করে অন্য কাজে। কেউ খাল রক্ষার উদ্যোগ নেয় না, বরং মুখ ফিরিয়ে থাকে। এই সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। অথচ নগর তো একটাই, সমস্যা একটাই-জলাবদ্ধতা।
খুলনার সমস্যা শুধুই সরকারি সংস্থার ব্যর্থতা নয়, নাগরিক দায়বোধের অভাবও এর একটি বড় কারণ। আমরা নিজেরাই ঘর বানানোর সময় প্লট ভরাট করি, খালপাড় দখল করি, ড্রেনে ময়লা ফেলি। এরপর আবার অভিযোগ করি-শহর ডুবে গেছে!
খুলনার বেশ কিছু নতুন আবাসন প্রকল্প (বিশেষত ময়লাপোতা, নিরালা, বয়রার আশপাশে) জলাধার ভরাট করে গড়ে উঠেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়েই চলছে এই দখল-উন্নয়ন। যে মাটি একসময় পানি শুষে নিত, এখন সেখান থেকে পানি সরার কোনো পথ নেই।
খুলনার জলাবদ্ধতা নির্মূল করা কোনো অলীক স্বপ্ন নয়-প্রয়োজন শুধু বাস্তবতা-ভিত্তিক পরিকল্পনা ও কঠোর বাস্তবায়ন।প্রথমত, খুলনার একটি একীভূত Smart Drainage Master Plan দরকার-যেখানে খাল, ড্রেন, জলাশয় এবং ভবিষ্যৎ বৃষ্টিপাত ও জলবায়ু ঝুঁকিকে মাথায় রেখে নগর ব্যবস্থাপনা সাজানো হবে। এই পরিকল্পনায় বুয়েট, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও নগর বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, দখলমুক্তি অভিযান হতে হবে ধারাবাহিক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। ইতোমধ্যে দখলকৃত খাল ও পুকুরগুলোর তালিকা তৈরি আছে। প্রয়োজন কেবল সেই তালিকা বাস্তবে কার্যকর করা এবং শহরবাসীকে সম্পৃক্ত করা।তৃতীয়ত, কেসিসিকে জনগণের কাছে আরও জবাবদিহি করতে হবে। ওয়ার্ডভিত্তিক নাগরিক পরিবেশ কমিটি গঠন করে জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নাগরিক মতামত নেওয়া দরকার।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের ভূমিকা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা নাগরিক সনদপত্রে স্বাক্ষর দেওয়াকেই দায়িত্ব পালন বলে মনে করেন। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। প্রতিটি কাউন্সিলরের উচিত নিয়মিত নিজের ওয়ার্ড পরিদর্শন করা, কোথায় ড্রেন বন্ধ হয়ে আছে, কোন রাস্তা ভেঙে গেছে, কোথায় পানি জমে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে-তা নিজে পর্যবেক্ষণ করে তাৎক্ষণিকভাবে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। তাদের মনে রাখতে হবে, একটি ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা ও সুষ্ঠু নাগরিক পরিবেশ অনেকাংশে নির্ভর করে সেই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের দক্ষতা, দায়বদ্ধতা এবং সমস্যার প্রতি সংবেদনশীলতার উপর।চতুর্থত, প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান-যেমন GIS ম্যাপিং, রেইন সেন্সর এবং IoT-নিয়ন্ত্রিত ড্রেন মনিটরিং চালু করতে হবে। এতে দ্রুত সংকট চিহ্নিত ও প্রতিক্রিয়া দেওয়া সম্ভব।
খুলনার জলাবদ্ধতা এখন আর শুধুই একটি অব্যবস্থাপনার ফল নয়, এটি একটি নগরের অস্তিত্ব সংকটের ইঙ্গিত। যদি আমরা এখনই জেগে না উঠি, পরিকল্পনা না করি এবং কঠোর বাস্তবায়নে না যাই-তাহলে অদূর ভবিষ্যতে খুলনা বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হবে।
সিটি কর্পোরেশনকে বলতেই হয়-আপনাদের আর সময় নেই। সমস্যা চিহ্নিত, সমাধানও জানা। এখন দরকার রাজনৈতিক ইচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং নাগরিক অংশগ্রহণ। শহর বাঁচাতে হলে, জলাবদ্ধতা রোধ করতে হবে-এবার উদ্যোগ নিতে হবে সত্যিই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। Email: amm203@gmail.com
খুলনা গেজেট/এনএম